Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাতব্যক্তিত্ব

 উনিশ শতকের শেষ ভাগে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে ছিলেন অধিকাংশ হিন্দু নেতা। তাঁদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে মুসলমান সম্প্রদায় ভৌগোলিক ও ভাষাগত জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ধর্মকেই জাতীয়তাবাদের মূল সূত্র হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান স্বদেশ চেতনা মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এমন কি মাতৃভাষার প্রতি তারা উদাসীন ছিল। সুচতুর ইংরেজরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ সৃষ্টি সহায়তা করে। মুসলিম নেতারা ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মূলধন করেছিল। তাদের পশ্চাত্মুখী নেতৃত্বের জন্য বিশ শতকের দু’দশক পর্যন্ত ‘মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ না ঘটায়, ভৌগোলিক জাতীয়তাবোধ তাদের মধ্যে দেখা দেয়নি। রাজনৈতিকভাবে বাঙালি মুসলমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ফজলুল হকের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি জনগণের মধ্যে চেতনাবোধ। তাদের মধ্যে যদি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যাপক চেতনা সৃষ্টি না হয়, তাহলে জাতীয়তাবাদের সূচনা সম্ভব নয়। এ কে ফজলুল হকের ধারণা ছিল শিক্ষার মাধ্যমে অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করা সম্ভব। শিক্ষা বিস্তার সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে জাতীয়তার শক্ত ভিত তৈরি করে। তিনি শক্তিশালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি করে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবোধ, বঞ্চনাবোধ ও রাষ্ট্রীয় কাজের অংশগ্রহণের অভাববোধকে দূর করে খাঁটি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

১৯১৩ সালে এ কে ফজলুল হক রাজনীতি অঙ্গনে প্রবেশ করে মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলমানদের শিক্ষাগত পশ্চাত্পদতা তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই তিনি বঙ্গীয় আইনসভায় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের বিষয়ে বার বার বক্তৃতা দিয়েছেন। সরকার বাধ্য হয়ে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি মুসলমানদের চাকরির সুবিধা করে দেন। ফলে বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের বিকাশ ঘটতে থাকে বাংলায়। মুসলিম সমাজের সেবার পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ১৯১৬ সালে লখেনৗ চুক্তির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এ সময় তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নেতা। ১৯১৮ সালে দিল্লিতে মুসলিম লীগ সম্মেলনে তিনি যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তা তাঁকে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা আসনে অধিষ্ঠিত করে। ১৯২০ সালে তিনি মেদিনীপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে তাঁর ভাষণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তা শেষত স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ও মহাজনী শোষণ বন্ধ করার জন্য ফজলুল হক প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর কৃষক-প্রজা সমিতির কর্মসূচি রাজনীতিকে দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পটভূমি তৈরি করতে সাহায্য করে। মুসলমান জমিদার-জোতদার আর হিন্দু জমিদার-মহাজনদের মুসলিম প্রজাদের শোষণের ব্যাপারে কোনো পার্থক্য ছিল না। এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য একটি নতুন শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হচ্ছিল। তারা ছিল গ্রাম-বাংলার কৃষকের সন্তান, তারা কৃষক সমাজের নেতৃত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। পল্লী-বাংলার ব্যাপক জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে ফজলুল হক যেমন নিজের অবস্থান ও রাজনীতির রূপরেখা নির্ধারণ করেছে, তেমনি নবাব-নাইট অধ্যুষিত মুসলিম লীগ নেতৃত্বের স্বরূপও তুলে ধরেছেন। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব কৃষকের সমস্যার কথা বললেও শুধু সাম্প্রদায়িক ফায়দা লোটার স্বার্থে কৃষকদের ব্যবহার করা ছাড়া তেমন কিছুই করেনি, করা তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। কংগ্রেস বোধগম্য কারণেই কৃষকের মৌল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেনি। ফজলুল হকের ভূমিকা এখানে মুসলিম লীগ বা কংগ্রেসের চাইতে ভিন্ন। শুধু ভোট পাওয়ার জন্য ধর্মের নামে তিনি মুসলিম কৃষকদের ব্যবহার করতে চাননি। তিনি কৃষকদের জন্য ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তিনি তাঁর মোকাবেলার জন্য রাজনীতি নির্ধারণ করেছিলেন। ফজলুল হকের আগে আর কোনো রাজনীতিবিদই বাংলাদেশের ব্যাপকসংখ্যক কৃষককে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে টেনে আনতে পারেননি। তিনি বাংলার রাজনীতিকে ঢাকার আহসান মঞ্জিল ও কলকাতা শহরের চৌহদ্দি থেকে রাজপথে, গ্রাম-বাংলার মাঠে-ঘাটে নিয়ে আসেন। এভাবে তিনি কৃষকদের মধ্যে সামাজিক বিপ্লবের প্রক্রিয়া চালু করতে পেরেছিলেন। ফজলুল হকের এটা মৌলিক অবদান। জাতীয়তাবাদের বিকাশে এ ঘটনার বিশেষ গুরুত্ব আছে। জাতীয়তাবাদের জন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। ফজলুল হকের চেষ্টায় তা প্রথমবারের মতো অর্জিত হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের অসম বিকাশের সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দলগুলো তখন পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে তত্পর। কৃষি ও শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে শেরে বাংলা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর কর্মসূচির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বাঙালি জাতি গঠন করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিরোধিতার জন্য তিনি এ সংগ্রাম পূর্ণ সফলতা লাভ না করলেও জাতি গঠনের সকল উপাদান সৃষ্টি করে যেতে সক্ষম হন। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতি গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ফজলুল হক জাতি গঠনের প্রারম্ভিক কাজটুকু শেষ করে যেতে পেরেছিলেন বলেই।

১৯৩৭ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভের পর ফজলুল হক কংগ্রেসের সঙ্গে জাতীয় সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অসহযোগিতার জন্য এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাঁকে বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগের সঙ্গে সরকার গঠন করতে হয়। এ সময় তাঁকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পর্যন্ত করতে হয়েছিল। ১৯৩৭-৪১ সালে মুসলিম লীগের অসহযোগিতার জন্য অনেক গণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন ফজলুল হক। তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। ১৯৪১-৪৩ সালে মন্ত্রিসভা আমলে তিনি একজন জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। এজন্য মুসলিম লীগ তাঁকে কংগ্রেসের দালাল, মুসলমানদের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেছে। ফজলুল হক ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক। তাই স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন, ফজলুল হক মাথার চুল হতে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি, সেই সঙ্গে তিনি খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়েই গঠিত হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতির ভবিষ্যত্ নির্ভর করে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ওপর এবং ফজলুল হক সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটিকে তাঁর গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁকে বলতে দেখেছি যে হিন্দু জমিদার, মহাজন ও মুসলমান জমিদার, মহাজন সমভাবে কৃষক-প্রজাদের ওপর নিপীড়ন চালায়। তাঁর চিন্তাধারায় সাম্প্রদায়িকতা নেই। আছে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও প্রগতিশীল চিন্তার পরিচয় । তিনি এ সমস্যাকে জানতেন এবং সকল সম্প্রদায়ের ঐক্যের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করতে চেয়েছিলেন। সেদিনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্রোতে তিনি পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেননি সত্য, তবু তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতোধারা ধরে রেখেছেন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের মাধ্যমে তাকে বিজয়ের পথে নিয়ে যাবার প্রয়াস চালান। সে বিজয়ের পথ ধরে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে সফলতা অর্জন করেন। তাঁর এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে ছিল শেরে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবদান। বস্তুত আজকের বাংলাদেশ ফজলুল হকের সৃষ্ট জাতীয়তাবাদেরই ফসল।